আড়াই শ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনো জনপ্রিয় বগুড়ার দই

 


বগুড়া এলাকাটির নাম মুখে এলেই আরেকটি শব্দ চলে আসে, তা হলো দই। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, স্বাদ আর জনপ্রিয়তার কারণে এখন বগুড়ার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দই। বগুড়াকে দেশের আনাচে-কানাচে পরিচিত করে তুলেছে দই।

জানা গেছে, দেশ বিভাগের সময় ১৯৪৭ সালে গৌর গোপাল ভারত থেকে বগুড়া আসেন পরিবার নিয়ে। বগুড়া থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বর্তমানে শেরপুর উপজেলা সদরে তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নেন। দই বানানোর পদ্ধতি তার জানা ছিল। শেরপুর থেকে দই বানিয়ে হেঁটে ভাঁড়ে করে আনতেন বগুড়া শহরের বনানী এলাকায়। মূলত দই তৈরি প্রথমে শুরু হয় শেরপুর থেকেই। এখনও দই তৈরিকে কেন্দ্র করে শেরপুরে একটি মহল্লার নামকরণ হয়েছে ‘ঘোষপাড়া’।

একসময় ঘোষ পরিবারকে বলা হতো দই তৈরির কারিগর। তবে এখন আর ঘোষদের হাতে সেই দইয়ের বাজার নেই। এটি এখন চলে গেছে মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের হাতে। এদের মধ্যে রফাত দই ঘর, মহররম আলী দই ঘর, বগুড়া দই ঘর, আকবরিয়ার দই, রুচিতা দইসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত দই তৈরি হচ্ছে।



প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ইতিহাস হলেও বগুড়ার দইয়ের প্রস্তুত প্রণালী ছিল অতি গোপনীয়। তবে সেটিকে আর তারা ধরে রাখতে পারেনি। এখন শেরপুরেই প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী দই তৈরি করে। এদের মধ্যে মাত্র ৯-১০ জন ঘোষ পরিবারের লোক।

জানা যায়, ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ থেকে শুরু করে মার্কিন মুল্লুকেও গিয়েছে বগুড়ার দই। এ দই প্রথমবারের মতো বিদেশে যায় ১৯৩৮ সালে। ওই বছরের গোড়ার দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ায় এলে দইয়ের স্বাদে এতটাই অভিভূত হন যে, তিনি সুদূর ইংল্যান্ডে নিয়ে যান সেই দই।

বগুড়া ও শেরপুরের বেশ কয়েকজন দই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার আবহাওয়া, পানি ও মাটি- তা পুরোটাই দই তৈরির উপযোগী। দই তৈরিতে এ জেলায় প্রতিদিন প্রায় ১৫শ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা ও উপজেলা থেকে দুধ সংগ্রহ করে এর চাহিদা মেটাতে হয়। প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকার দই বিকিকিনি হয় এ জেলায়। কাপ দই বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা, সরার দই বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, পাতিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, ডুঙ্গি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা, খাদা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, স্পেশাল সরার দই ২০০ টাকায় বিক্রি হয়।

দই প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, বিবোফ্লাভিন, ভিটামিন ই ১৬, ভিটামিন ই ১২ সমৃদ্ধ। দই খেলে মানব দেহের পাকস্থলীর উপকারীর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বিষাক্ত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীর সুরক্ষিত থাকে। তাই দই শিল্পের সম্ভাবনা খুবই আশাব্যঞ্জক।

তবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা দইয়ের মান ঠিক রাখছেন না। উপরি টাকার লোভে তারা ভেজাল দিচ্ছেন। ফলে বগুড়ার দইয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে দেশীয় বাজারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এর মাধ্যমে প্রতিদিন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

দই কারিগর সচীন বলেন, ৪০০ মণ দুধে দই হয় ৩০০ মণ। যা চুলার আগুনে কড়াইয়ের মধ্যে দুধ জাল দিয়ে কমাতে হয়। প্রতি সরায় দুধ লাগে ৭০০ গ্রাম, চিনি ১৮০ গ্রাম। শেরপুর উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এই দই তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতিষ্ঠানও রয়েছে শতাধিক।

দই কারিগর টিপু বলেন, ‘দই তৈরি করতে আমার ভালো লাগে। কারণ এটি আমাদের শেরপুরের ঐতিহ্য।’

দুধ বিক্রেতা সুকুমার বলেন, ‘শেরপুরের দইয়ের নাম-ডাক সারাদেশে। আমরা দূর-দূরান্ত থেকে ভালো দুধ নিয়ে এখানে আসি। দইয়ের সুনাম যেন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে, সে জন্য সবকিছু ভালো দেওয়ার চেষ্টা করি।’

দই শো-রুমের ব্যবসায়ী বাসুদেব সরকার বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। আমাদের পূর্ব পুরুষরাও এটা করেছেন। কিন্তু দই তৈরির পদ্ধতি অন্যদের হাতে চলে যাওয়ায় মান যেমন কমেছে, তেমনি লাভের মুখ দেখাও কমেছে।’

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url